ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা বেপরোয়া কেন?
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগে ও জরুরি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা৷ এসব হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি থাকে যে, তারা মাঝে মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন৷ যদিও এটা কোনভাবেই কাম্য নয়৷ কোনো চিকিৎসক রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তুলতে পারেন না৷ কেউ এমনটা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷
সর্বশেষ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগীর ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা৷ এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ পাশাপাশি অভিযুক্ত দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ শুধু রাজশাহী নয়, এর আগে বগুড়া, বরিশাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷ রাজশাহীতে দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও এর আগের কোন ঘটনায় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি৷
কী হয়েছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে?
রাজশাহী শহরের বোসপাড়ার বাসিন্দা ও স্থানীয় মোবাইল যন্ত্রাংশের মিস্ত্রী সুমন পারভেজ রিপন তার মা পিয়ার বেগমকে (৬০) শ্বাসকষ্টের কারণে গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন৷ ভর্তির ৫ দিন পরও চিকিৎসকেরা বলছিলেন না তার মায়ের কী হয়েছে৷ প্রতিদিন কিছু কিছু করে টেস্ট দেওয়া হয়, রিপোর্ট দেখার পরও চিকিৎসকরা কিছু বলেন না৷ ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে চিকিৎসকরা রাউন্ডে আসলে রিপন তাদের কাছে জানতে চান তার মায়ের কী হয়েছে? তখন তাকে কিছু বলেননি চিকিৎসকরা৷ এ সময় তার মা চিকিৎসকদের কাছে তার অসুখের কথা জানতে চান৷ বরং তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চিকিৎসকেরা নিজেদের মধ্যে পড়াশোনার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন৷ এতে রিপন বিরক্ত হয়ে বারবার প্রশ্ন করতে থাকেন৷
সুমন পারভেজ রিপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার প্রশ্নের কারণে তারা আমাকে অশিক্ষিত বলে ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যান৷ তখন মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল৷ আমি মাকে নেবুলাইজার দেওয়ার উদ্যোগ নিই৷ এর মধ্যে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে আমাকে বলেন, আপনি তো মায়ের কী হয়েছে জানতে চান? আমাদের রুমে আসেন৷ আমি রুমে ঢুকতেই দেখি ১৫-২০ জন অপেক্ষা করছে৷ এর মধ্যে একজন আনসারও আছে৷ একজন রুমের ছিটকানি বন্ধ করে দেয়৷ এরপর তারা আমাকে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে৷ আধা ঘণ্টা ধরে তারা আমাকে পেটায়৷ এ সময় একজন আমাকে বলেন, বাইরে যদি এই ঘটনা বলি তাহলে তারা ইঞ্জেকশন দিয়ে আমার মাকে মেরে ফেলবে৷ বাইরে বের হয়ে যেন আমি সোজা হয়ে হাঁটি৷ পেটানোর এক পর্যায়ে আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ভিডিও চালু করে দেই৷ প্রথম দুই মিনিট ভিডিও দেখা গেলেও পরে আর দেখা যায়নি কারণে মোবাইল তখন ভিডিও চালু করা অবস্থায় পকেটে মধ্যে রেখে দেই৷”
শুক্রবার বিকেলে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে মি. রিপন বলেন, "আমি এখন একটা ফেসবুক পোস্ট লিখছি, কিছুক্ষণের মধ্যে পোস্ট করব৷ আমি বা আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই চিকিৎসকরা দায়ী থাকবেন৷ ওই ঘটনার পর আমার মাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় এনে ফেলে রেখেছি৷ অথচ এখনও তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে৷ আমি নিজেও চিকিৎসা নিতে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম৷ কেউ চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি৷ পরে মুখ লুকিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম৷ পরে চলে এসেছি৷ প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করছি৷ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি৷ এখনও কোন বিচার পাইনি৷”
রিপনের সেই ৭ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে৷ ভিডিওটির প্রথম ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড দেখা গেলেও পরের অংশটুকু অন্ধকার৷ তবে মারধরের শব্দ, আকুতি, অশ্লীল কথাবার্তা এসব বোঝা যাচ্ছিল৷ রিপনকে বলতে শোনা যাচ্ছিল, "আর মাইরেন না ভাই৷ ম্যালা মাইর্যাছেন ভাই৷ আমাকে একটু পানি খেতে দেন৷ আমি মরে যাব৷ আমি ভুল করেছি৷ ক্ষমাই চাইছি৷ আর মাইরেন না৷ আমাকে মারার কথা আম্মাকে বইলেন না৷ আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে৷” এ সময় চিকিৎসকদের একজনকে রিপনকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতে শোনা যায়৷ এক পর্যায়ে একজন চিকিৎসক বলেন, "বল মাফ চাইছস৷” তখন রিপন বলেন, "হ, মাফ চাইছি৷” এরপরও রিপনকে মারধরের শব্দ শোনা যায়৷ একজন তার মাথা ন্যাড়া করে দিতে চান৷ এ ছাড়া ‘চিকিৎসকদের মারতে চাওয়ায়' রিপনের হাত কেটে নিতে চান আরেকজন৷
এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ বিষয়ে রিপন আমার কাছে অভিযোগ করেছে৷ আমি একটি বিভাগের সভাপতিকে প্রধান করে একটি কমিটি করেছি৷ রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি ফরহাদ হাসান ও আলমগীর হোসেন নামে দুইজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে সময়িক বরখাস্ত করেছি৷”
চিকিৎসকরা কেন রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তুলবে? জানতে চাইলে মি. আহমেদ বলেন, "এটা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ আসলে ১২শ' শয্যার হাসপাতালে রোগী থাকে সাড়ে ৩ হাজার৷ বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ৬ হাজারের বেশি রোগী আসে৷ সবকিছু মিলিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার মানুষকে আমাদের হ্যান্ডেল করতে হয়৷ এসব কারণে অনেক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে৷ তবে কারো গায়ে হাত দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফরহাদ হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, সেটা তো আমরা বলতেই পারি৷ কিন্তু পরিচালক মহোদয় আমাদের কোন কথা বলতে নিষেধ করেছেন৷ যেহেতু তদন্ত চলছে, ফলে আমরা কিছু বলতে পারি না৷ তদন্ত অনুযায়ি যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা আমরা মেনে নেব৷”
গত ৫ বছরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অন্তত ১০ জন রোগীর স্বজন লাঞ্ছিত হয়েছেন৷ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর লাশ ওয়ার্ডে রেখে ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তার ছেলেকে পিটিয়েছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা৷ জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলার সভাপতি ডা. চিন্ময় কান্তি দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একদিনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি৷ আমাদের সংকটের মূলে যেতে হবে৷ হাসপাতালে ঢুকলেই দেখবেন শত শত অ্যাম্বুলেন্স৷ দালালদের চক্করে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেখানে কাজ করা কঠিন৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এসব ঘটনা দেখতে হবে৷ পাশাপাশি কোনো ঘটনা ঘটলে সেটার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সেটা যেই হোক৷ আমরা চাই সুষ্ঠু একটা চিকিৎসার পরিবেশ যেন গড়ে ওঠে৷”
একই ধরনের ঘটনা বারবার?
গত ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন গৌরনদীর রিজিয়া বেগম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ তখন ব্যক্তিগত কাজের অজুহাত দেখিয়ে চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানায় দায়িত্বরত চিকিৎসক৷ পরে বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে রোগীর এক স্বজন চিকিৎসকের রুমে কথা বলতে যান৷ এসময় আনসার সদস্যদের সহযোগিতায় দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তার উপর হামলা চালায়৷ এ সময় সেখানে উপস্থিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম ইকবাল রাজু ও তার বন্ধু মুজাহিদ প্রতিবাদ করেন৷ চিকিৎসকরা তাদেরও মারধর করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়৷
মৃত রোগীর স্বজন মো. নাসির বলেন, "আমার দাদী রিজিয়া বেগম অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ দাদীকে একটু দেখার জন্য চিকিৎসককে বারবার অনুরোধ করি, কিন্তু তারা আসেনি৷ যার আধা ঘণ্টা পরে আমার দাদি মৃত্যুবরণ করেন৷ এরপর আমার চাচা ও আমি চিকিৎসকদের বলি, আপনারা কি মানুষ? আপনার মা বাবা অন্য কারও এমন হলে আপনি কী করতেন৷ এমন কথা বলায় তারা কয়েকজন মিলে আমাদের এলোপাথাড়ি কিল, ঘুসি মারতে শুরু করে৷ এমনকি আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে৷ এমনকি আমার দাদীর মরদেহটিও আটকে রাখে৷”
চিকিৎসকদের এই ধরনের ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের এই ধরনের আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়৷ সবাইকে সহনশীল হতে হবে৷ আসলে আমাদের সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে৷ এর প্রভাবের বাইরে নন চিকিৎসকরা৷ চিকিৎসকদের বুঝতে হবে এটা মহান পেশা৷ অন্য পেশাগুলোর সঙ্গে মেলালে হবে৷ রাজনৈতিক কারণে কেউ ক্ষমতাবান হয়ে অন্য কারও সঙ্গে খারপ ব্যবহার করতে পারেন না৷”
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালেও ২০১৯ সালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরে আহত হয়েছিলেন হৃদরোগী মাজেদা বেগম (৫০), তার ভাই ও তিন ছেলেমেয়ে৷ কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে মাজেদা বেগমকে অবজারভেশন ওয়ার্ডে স্থানাস্থর নিয়ে বাকবিতণ্ডার জের ধরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির সঙ্গে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে৷ পরে রোগী ও তার লোকজনদের ছাড়পত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে৷ ঢাকা মেডিকেলেও গত বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷ রোগীর স্বজনের সঙ্গে তর্কাতর্কির জেরে কর্মবিরতিতে যান ইন্টর্ন চিকিৎসকরা৷
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এক চোখে দেখলে হবে না৷ চিকিৎসকরাও তো লাঞ্ছিত হচ্ছেন৷ এগুলোও দেখতে হবে৷ তবে আমি কারও পক্ষে সাফাই গাচ্ছি না৷ যে ঘটনায় যিনি অভিযুক্ত হবেন, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আমরা খুব শিগগিরই মন্ত্রীর সঙ্গে এসব নিয়ে বসব৷ আশা করি সমাধানের একটা পথ বের হবে৷”